সূরা ফাতেহার তাফসির
أَعُوْذُ بِاللّٰهِ (আঊযুবিল্লাহ)-এর প্রাসঙ্গিক আলোচনা
কুমন্ত্রণাদানকারী শয়তান হতে মহান আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাওয়া প্রতিটি মু’মিন-মুসলিমের একান্ত কর্তব্য। কারণ আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করার পর হতে শয়তান মানুষের অনিষ্ট করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন:
(لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيْمَ)
(শয়তান বলল:) “আমি (বানী আদমকে বিভ্রান্ত করার জন্য) আপনার সরল পথে অবশ্যই বসে থাকব।”(সূরা আ‘রাফ ৭:১৬) তাই শয়তানের অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকার জন্য الاستعاذة বা আঊযুবিল্লাহ পাঠ করার গুরুত্ব অপরিসীম।
আঊযুবিল্লাহ পাঠ: আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَقُلْ رَّبِّ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ هَمَزٰتِ الشَّيٰطِيْنِ وَأَعُوْذُ بِكَ رَبِّ أَنْ يَّحْضُرُوْنِ)
“বল: হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি সকল শয়তানের প্ররোচনা হতে, আর হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করি আমার নিকট তাদের উপস্থিতি হতে।”(সূরা মু’মিনুন ২৩:৯৭-৯৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(وَإِمَّا يَنْزَغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطٰنِ نَزْغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللّٰهِ ط إِنَّه۫ هُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ)
“যদি শয়তানের কুমন্ত্রণা তোমাকে প্ররোচিত করে তবে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা কর। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।”(সূরা হা-মীম সিজদাহ ৪১:৩৬)
উপরোক্ত আয়াতগুলোর আলোকে বলা যায়: সাধারণত আঊযুবিল্লাহ পাঠ করা মুস্তাহাব। ইমাম ইবনু কাসীর (রহঃ) বলেন: কুরআন তেলাওয়াতের শুরুতে আঊযুবিল্লাহ পাঠ করা ওয়াজিব। তিনি দলীলস্বরূপ নিম্নোক্ত আয়াতটি পেশ করেছেন:
(فَإِذَا قَرَأْتَ الْقُرْاٰنَ فَاسْتَعِذْ بِاللّٰهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ)
“যখন কুরআন পাঠ করবে তখন অভিশপ্ত শয়তান হতে আল্লাহর আশ্রয় চাও।”(সূরা নাহল ১৬:৯৮)
উক্ত আয়াতে فَاسْتَعِذْ (আশ্রয় চাও) আদেশসূচক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যা আবশ্যকের অর্থ প্রদান করে। অতএব কুরআন পাঠের সময় আঊযুবিল্লাহ পাঠ করা ওয়াজিব।
সালাতে আঊযুবিল্লাহ পাঠ: সালাতের মধ্যে ছানা পাঠের পর কিরাআত পড়ার আগে আ‘ঊযুবিল্লাহ পড়া ওয়াজিব। (তাফসীর ইবনে কাসীর)
সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সালাতে দাঁড়িয়ে ইসতিফতাহ (ছানা) পড়ার পর পড়তেন:
(أَعُوذُ بِاللّٰهِ السَّمِيْعِ الْعَلِيْمِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ مِنْ هَمْزِهِ، وَنَفْخِهِ، وَنَفْثِهِ)
অর্থাৎ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ আল্লাহর নিকট শয়তানের খোঁচা, ফুৎকার ও প্ররোচনা হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। (আবূ দাঊদ হা: ৭৭৫, সহীহ)
ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন: এ ব্যাপারে এই হাদীসটি অধিক প্রসিদ্ধ। ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন: এটি সালাতের প্রথম রাকাতে কিরাআতের পূর্বে বলতে হবে। (নাইলুল আওতার: ২/১৯৭-১৯৮)
উল্লেখ্য যে, ফরয-সুন্নাত ও নফল যে কোন সালাতে শুধু প্রথম রাকাতে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছানা ও আঊযুবিল্লাহ পড়তেন, আর বাকি রাকাতগুলোতে পড়তেন না। (সহীহ মুসলিম হা: ১৩৮২, মিশকাত পৃঃ ৭৮)
আঊযুবিল্লাহ-কে বিসমিল্লাহ-এর মতই চুপে চুপে পড়তে হবে। কারণ সরবে পড়ার স্বপক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীগণ কখনো সরবে পড়েননি।
আঊযুবিল্লাহ পাঠের ফযীলত: সুলাইমান বিন সূরাদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, দু’ব্যক্তি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিকটে গালাগালি করছিল। এতে একজন খুব রেগে গেল এবং তাঁর চেহারা লাল হয়ে গেল, শিরা-উপশিরাগুলো মোটা হয়ে গেল। অতঃপর নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন:
(إِنِّيْ لَأَعْلَمُ كَلِمَةً لَوْ قَالَهَا لَذَهَبَ عَنْهُ مَا بِهِ؛ أعُوذُ باللّٰهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ)
নিশ্চয়ই আমি এমন একটি বাক্য জানি, যদি সে ঐ বাক্যটি পড়ে তাহলে তার হতে ঐ জিনিস চলে যাবে যা তার সাথে আছে (অর্থাৎ রাগ চলে যাবে)। আর সেই বাক্যটি হল,
أعُوْذُ باللّٰهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ
(সহীহ বুখারী হা: ৬১১৫, ৬০৪৮, ৩২৮২, সহীহ মুসলিম হা: ২৬১০ )
অন্য এক হাদীসে উসমান বিন আবুল আস সাকাফী (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তিনি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! নিশ্চয়ই শয়তান আমার মাঝে এবং আমার সালাতের মাঝে অন্তরাল সৃষ্টি করে দেয়। অর্থাৎ আমাকে সন্দেহে ফেলে দেয় (এতে আমার করণীয় কী?)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঐ লোকটিকে বললেন,
ذَاكَ شَيْطَانٌ يُقَالُ لَهُ خِنْزَبٌ فَإِذَا أَحْسَسْتَهُ فَتَعَوَّذْ بِاللّٰهِ مِنْهُ وَاتْفِلْ عَلَي يَسَارِكَ ثَلاَثًا
এ হলো ঐ শয়তান যার নাম “খিনজাব”। অতএব যখন তাকে অনুভব করবে তখন আল্লাহ তা‘আলার নিকট তার হতে আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং বাম দিকে তিনবার হালকা থুথু ফেলবে। সাহাবী বলেন, আমি তা-ই করলাম। ফলে আল্লাহ তা‘আলা আমার হতে ঐ শয়তানকে দূরে সরিয়ে নিলেন। (সহীহ মুসলিম হা: ২২০, মুসনাদ আহমাদ হা: ১৭৪৪০)
নামকরণ:
اَلْفَاتِحَةُ (আল-ফাতিহা) অর্থ সূচনা, ভূমিকা, প্রারম্ভিকা ইত্যাদি। পবিত্র কুরআনুল কারীম এ সূরা দ্বারা শুরু করা হয়েছে বিধায় এর নামকরণ করা হয়েছে সূরা আল ফাতিহা, অনুরূপভাবে সালাতের কিরাআতও শুরু হয় এ সূরা দ্বারা।
এ সূরার আরো অনেক নাম রয়েছে- তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপ:
১. اَلسَّبْعُ الْمَثَانِيُّ
আস্সাবউল মাসানী বা সাতটি অধিক পঠিতব্য আয়াত: (তিরমিযী হা: ৩১২৪, আবূ দাঊদ হা: ১৪৫৭, সহীহ) আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَقَدْ اٰتَيْنٰكَ سَبْعًا مِّنَ الْمَثَانِيْ)
“আমি তোমাকে সাবআ মাসানি (বারবার পঠিত সাতটি আয়াত) প্রদান করেছি।”(সূরা হিজর ১৫:৮৭)
২. اَلصَّلَاةُ আস্ সালাত: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
قَسَمْتُ الصَّلَاةَ بَيْنِيْ وَبَيْنَ عَبْدِيْ نِصْفَيْنِ
আমি সালাতকে (সূরা ফাতিহাকে) আমার ও আমার বান্দার মাঝে দু’ভাগে ভাগ করেছি। (সহীহ মুসলিম হা: ৯০৪, ৯০৬)
৩. اَلرُّقْيَةُ আর রুক্ইয়াহ বা ঝাড়ফুঁক: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের কৃত সূরা ফাতিহার মাধ্যমে ঝাড়ফুঁক সমর্থন করে বলেন:
وَمَا يُدْرِيْكَ أَنَّهَا رُقْيَةٌ
তুমি কী করে জানলে এটি ঝাড়ফুঁকের সূরা? (সহীহ বুখারী হা: ২২৭৬)
৪. أُمُّ الْقُرْاٰنِ উম্মুল কুরআন বা কুরআনের মা/মূল: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি সালাত আদায় করল অথচ উম্মুল কুরআন (সূরা ফাতিহা) পাঠ করল না তা অসম্পূর্ণ। (সহীহ মুসলিম হা: ৩৯৫)
৫. فَاتِحَةُ الْكِتَابِ ফাতিহাতুল কিতাব বা কুরআনের ভূমিকা: রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি ফাতিহাতুল কিতাব (সূরা ফাতিহা) পাঠ করবে না তার সালাত হবে না। (সহীহ বুখারী হা: ৭৫৬, সহীহ মুসলিম হা: ৩৯৪) এছাড়াও এ সূরাকে سُوْرَةُ الْحَمْدِ (সূরাতুল হাম্দ বা প্রশংসার সূরা), سُوْرَةُ الْمَسْأَلَةِ (সূরাতুল মাসআলাহ বা আবেদনের সূরা), اَلْقُرْاٰنُ الْعَظِيْمُ (আল কুরআনুল আযীম), سُوْرَةُ الشِّفَاءِ (সূরাতুশ শিফা বা আরোগ্যের সূরা) ইত্যাদি বলা হয়ে থাকে।
অবতরণের সময়কাল:
সূরা ফাতিহাহ অবতরণের সময়কাল সম্পর্কে ইবনু আব্বাস (রাঃ) ও কাতাদাহ (রহঃ) বলেন- এটি মক্কায় অবতীর্ণ, আবূ হুরায়রা (রাঃ) ও মুজাহিদ (রহঃ) বলেন- মদীনায় অবতীর্ণ, আবার কেউ বলেন- দু’বার অবতীর্ণ হয়েছে; একবার মক্কায় এবং আরেকবার মদীনায়।
তবে সবচেয়ে বেশি বিশুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য মত হল এ সূরা মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَقَدْ اٰتَيْنٰكَ سَبْعًا مِّنَ الْمَثَانِيْ)
“আমি তোমাকে সাবআ মাসানি (বারবার পঠিত সাতটি আয়াত) প্রদান করেছি।”(সূরা হিজর ১৫:৮৭) এ আয়াতে সাবাআ মাসানী দ্বারা সূরা ফাতিহাকে বুঝানো হয়েছে। আর এ আয়াতটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং সূরা ফাতিহা মক্কায় অবতীর্ণ হওয়াটাই অধিক যুক্তিযুক্ত। (আল্লাহ তা‘আলাই সবচেয়ে ভাল জানেন)
সূরা ফাতিহার গুরুত্ব ও তাৎপর্য:
সূরা ফাতিহার গুরুত্বের ব্যাপারে অসংখ্য সহীহ হাদীস পাওয়া যায়, সাহাবী উবাদা বিন সামিত (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
لَا صَلَاةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ
যে ব্যক্তি সালাতে সূরা ফাতিহা পড়ল না তার সালাত হল না। (সহীহ বুখারী হা: ৭৫৬, সহীহ মুসলিম হা: ৩৯৪)
অনুরূপ বিশিষ্ট সাহাবী আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: “যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা ছাড়াই সালাত আদায় করল তার সালাত অসম্পূর্ণ।”তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এ অসম্পূর্ণ কথাটি তিন বার বললেন। আবূ হুরায়রা (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, আমরা তো ইমামের পেছনেও সালাত আদায় করি, তখন আমরা কী করব? তিনি বললেন: তোমরা তা (সূরা ফাতিহা) ইমামের পেছনে মনে মনে পাঠ করবে। (সহীহ মুসলিম হা: ৩৯৫)
উবাদা বিন সামিত (রাঃ) বলেন: একদা আমরা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পিছনে ফজরের সালাত পড়লাম। সালাতে তাঁর কিরাআত ভারী মনে হল, সালাত শেষে জিজ্ঞাসা করলেন: মনে হয় তোমরা ইমামের পেছনে থাকা অবস্থায় কিরাআত পাঠ কর? আমরা বললাম: হ্যাঁ, পাঠ করি। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন: তোমরা সূরা ফাতিহা ব্যতীত আর অন্য কিছু পাঠ কর না, কেননা যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে না তার সালাত হয় না। (আবূ দাঊদ হা: ৮২৩, তিরমিযী হা: ৩১১, নাসাঈ হা: ৯২১, হাসান)
উল্লিখিত হাদীসগুলো থেকে এ কথা পরিষ্কার হয় যে, কুরআন পাঠের সময় মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করা ও চুপ থাকার নির্দেশ (সূরা আ’রাফ ৭:২০৪)-এর সাথে হাদীসগুলোর কোন বিরোধ নেই। কারণ, জাহরী (সরবে কিরাআত বিশিষ্ট) সালাতগুলোতে মুক্তাদী ইমামের কুরআন পাঠ মনোযোগসহকারে শুনবে এবং সূরা ফাতিহা ব্যতীত ইমামের সাথে কুরআন পাঠ করবে না। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যেখানে নিজে ইমাম, সাহাবীগণ মুক্তাদী, আর তাঁরা এমন সালাত আদায় করলেন যার কিরাআত ছিল সরবে সে অবস্থাকে কেন্দ্র করে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ফায়সালা হল সূরা ফাতিহা পাঠ ছাড়া সালাতই হবে না। অতএব এ বিষয়ে কোন অস্পষ্টতা ও দ্বিমতের অবকাশ নেই। এছাড়াও সূরা আরাফের ২০৪ নং আয়াত অবতীর্ণ হয় মক্কায় আর সূরা ফাতিহা পাঠের নির্দেশ হয় মদীনায় সুতরাং শরীয়তের নীতিমালা অনুযায়ী পরবর্তী নির্দেশ অবশ্যই প্রাধান্য পায়। আরো বলা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ওপর সূরা আরাফের উক্ত আয়াত নাযিল হয়েছে আর তিনিই ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন, সুতরাং এর পর আর কোন অস্পষ্টতা ও বিরোধ থাকতে পারে না।
সূরা ফাতিহার ফযীলত:
সূরা আল-ফাতিহা পবিত্র কুরআনুল কারীমের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ অবতীর্ণ হওয়া একটি সূরা। এর ফযীলত সম্পর্কে অনেক বর্ণনা রয়েছে। যেমন,
১. প্রসিদ্ধ সাহাবী আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা বলেন, সূরা ফাতিহাকে আমার ও আমার বান্দার মধ্যে দু’ভাগে ভাগ করেছি এবং বান্দা যা চায় তা তার জন্য। যখন বান্দা বলে:
(الْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ)
তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার বান্দা আমার প্রশংসা করছে। যখন বান্দা বলে:
(الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ)
তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার বান্দা আমার গুণগান করছে। যখন বান্দা বলে:
(مَالِكِ يَوْمِ الدِّيْنِ)
তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমার বান্দা আমার মর্যাদা বর্ণনা করছে। যখন বান্দা বলে:
(إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ)
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, এটি আমার ও বান্দার মধ্যে সমান এবং বান্দা যা চায় তা তার জন্য। যখন বান্দা বলে:
(اِھْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِیْمَﭕﺫ صِرَاطَ الَّذِیْنَ اَنْعَمْتَ عَلَیْھِمْﺃ غَیْرِ الْمَغْضُوْبِ عَلَیْھِمْ وَلَا الضَّا۬لِّیْنَﭖﺟ)
তখন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, এটি আমার ও বান্দার মধ্যে সমান এবং বান্দা যা চায় তা তা জন্য। (সহীহ মুসলিম হা: ৯০৪, ৯০৬)
২. অন্য হাদীসে বলা হয়েছে জিবরীল (আঃ) একদা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে বললেন: আপনি এমন দু’টি নূরের (আলোর) সুসংবাদ গ্রহণ করুন যে দু’টি নূর আপনি ব্যতীত পূর্ববর্তী কোন নাবীকে দেয়া হয়নি। একটি সূরাতুল ফাতিহাহ এবং অন্যটি সূরাতুল বাকারাহ-এর শেষ দু’টি আয়াত। (সহীহ মুসলিম হা: ১৯১৩, নাসাঈ হা: ৯১২)
৩. সাহাবী আবূ সাঈদ বিন মুয়াল্লা (রাঃ) বলেন, একদা আমি সালাতে ছিলাম, আমাকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ডাকলেন। আমি তাঁর ডাকে সাড়া দিলাম না। আমি সালাত শেষ করে তাঁর কাছে এলাম। তিনি বললেন: আমি যখন তোমাকে ডাকলাম তখন কিসে তোমাকে আমার ডাকে সাড়া দিতে বাধা দিয়েছে? তিনি (আবূ সাঈদ) বলেন, আমি বললাম- হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমি সালাতে ছিলাম। তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, আল্লাহ তা‘আলা কি একথা বলেননি:
(یٰٓاَیُّھَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اسْتَجِیْبُوْا لِلہِ وَلِلرَّسُوْلِ اِذَا دَعَاکُمْ لِمَا یُحْیِیْکُمْﺆ),
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ডাকে সাড়া দাও যখন তোমাদের তিনি জীবন সঞ্চারক বস্তুর দিকে ডাকেন।”(সূরা আনফাল ৮:২৪) অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাকে বললেন, আমি তোমাকে মাসজিদ থেকে বের হবার পূর্বেই কুরআনের সবচেয়ে বড় সূরা শিক্ষা দেব। সাহাবী বললেন- এ বলে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমার হাত ধরলেন। যখন তিনি মাসজিদ থেকে বের হতে যাচ্ছিলেন, তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল আপনি তো বলেছিলেন, আমাকে কুরআনের সবচেয়ে বড় সূরা শিক্ষা দেবেন? তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন হ্যাঁ। তা হল-
(الْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ)
“সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।”এটি সাবআ মাসানি, কুরআনুল আযীম যা আমাকে দেয়া হয়েছে। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪৭৪)
৪. সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর একদল সাহাবী কোন এক সফরে যাত্রা করেন। তারা এক আরব গোত্রে পৌঁছে তাদের মেহমান হতে চাইলেন। কিন্তু তারা তাদের মেহমানদারী করতে অস্বীকার করল। সে গোত্রের সরদার সাপে দংশিত হল। লোকেরা তার আরোগ্যের জন্য সব ধরনের চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই কোন উপকার হল না। তখন তাদের কেউ বলল, ঐ কাফেলা যারা এখানে অবতরণ করেছে হয়তো তাদের কাছে কিছু পাওয়া যেতে পারে। তারা তাদের নিকট গেল এবং বলল, হে যাত্রীদল! আমাদের সরদারকে সাপ দংশন করেছে, আমরা সবরকমের চেষ্টা করেছি, কিন্তু কোন উপকার হচ্ছে না। তোমাদের কারো নিকট কিছু আছে কি? তাদের (সাহাবীদের) একজন বলল, হ্যাঁ। আল্লাহ তা‘আলার শপথ! আমি ঝাড়ফুঁক করতে পারি। আমরা তোমাদের মেহমানদারী কামনা করেছিলাম, কিন্তু তোমরা আমাদের মেহমানদারী করনি। কাজেই আমি তোমাদের ঝাড়ফুঁক করব না, যে পর্যন্ত না তোমরা আমাদের জন্য পারিশ্রমিক নির্ধারণ কর। তখন তারা একপাল বকরী প্রদানের শর্তে তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হল। তারপর তিনি গিয়ে
(الْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ)
সূরা ফাতিহা পড়ে তার চিকিৎসা করলেন। ফলে আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছায় সে বন্ধনমুক্ত হল এবং সে এমনভাবে চলতে লাগল যেন তার কোন কষ্টই ছিল না......হাদীসের শেষ পর্যন্ত। (সহীহ বুখারী হা: ২২৭৬, ৫০০৭, ৫৭৩৬, ৫৭৪৯, সহীহ মুসলিম হা: ২২০১, আহমাদ হা: ১১৩৯৯)
৫. উবাই বিন কাব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: উম্মুল কুরআনের (সূরা ফাতিহার) ন্যায় তাওরাত ও ইঞ্জিলে আল্লাহ তা‘আলা কোন কিছুই অবতীর্ণ করেননি। এ উম্মুল কুরআন সাবআ মাসানি। (তিরমিযী হা: ৩১২৫, নাসায়ী হা: ৯১৪, আল-জামি আল-সহীহ হা: ৫৫৬০, শাইখ আলবানী সহীহ বলেছেন)
কেউ কেউ সূরা ফাতিহাকে কবর যিয়ারত করতে মৃত ব্যক্তির পাশে বসে ও কবরে মৃত ব্যক্তির মাথার দিকে দাঁড়িয়ে পাঠ করে থাকে। এগুলো তাদের মনগড়া কাজ, যা বিদ‘আত। সুতরাং তা অবশ্যই বর্জনীয়।
১-২ নং আয়াতের তাফসীর:
বিসমিল্লাহর পূর্বে أَقْرَأُ (আক্রাউ) বা أَبْدَأُ (আব্দাউ) এমন একটি ক্রিয়া গোপন রয়েছে যার অর্থ আল্লাহ তা‘আলার নামে শুরু করছি বা তেলাওয়াত করছি।
“বিসমিল্লাহ” এর প্রাসঙ্গিক আলোচনা: ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’প্রত্যেক সূরার স্বতন্ত্র একটি আয়াত, নাকি প্রত্যেক সূরার আয়াতের অংশ, না কেবল সূরা ফাতিহার একটি আয়াত, না কোন সূরারই স্বতন্ত্র আয়াত নয়; বরং এক সূরা থেকে অন্য সূরাকে পৃথক করার জন্য প্রত্যেক সূরার শুরুতে লেখা হয়েছে? এ বিষয়ে কিছু মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। তবে “বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম” সূরা নামলের ৩০ নং আয়াতের অংশ এ ব্যাপারে সকলে একমত।
১. সাহাবী আলী (রাঃ), ইবনু আব্বাস (রাঃ), সাঈদ বিন যুবাইর (রাঃ) প্রমুখের মতে এটি সূরা তাওবাহ ব্যতীত প্রত্যেক সূরার শুরুতে একটি পৃথক আয়াত। তাবেয়ী আব্দুল্লাহ বিন মুবারক এবং ইসহাকও এ মত পোষণ করেছেন।
২. ইমাম শাফিঈ (রহঃ) এর মতে, এটি শুধু সূরা ফাতিহার আয়াত অন্য সূরার আয়াত নয়।
৩. আবূ হানিফা ও ইমাম মালেক (রহঃ) এর মতে, এটি সূরা ফাতিহার আয়াত তো নয়ই এমনকি অন্য সূরারও আয়াত নয়। (ইবনে কাসীর, বিসমিল্লাহর তাফসীর)
তবে সঠিক কথা হলো “বিসমিল্লাহির রাহমানি রাহীম” সূরা নামলের মতই সূরা ফাতিহার একটি আয়াত। আর অন্যান্য সূরার শুরুতে লেখা হয়েছে বরকত হাসিল ও এক সূরা থেকে অপর সূরাকে পৃথক করার জন্য।
প্রথম দলীল: সাহাবী আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
إِذَا قَرَأْتُمُ الْحَمْدَ لِلّٰهِ فَاقْرَءُوا (بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ) إِنَّهَا أُمُّ الْقُرْآنِ وَأُمُّ الْكِتَابِ وَالسَّبْعُ الْمَثَانِيْ وَ (بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ) إِحْدَاهَا
যখন তোমরা আল-হামদুল্লিাহ বা সূরা ফাতিহা পাঠ শুরু কর তখন ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’পাঠ কর। কেননা সূরা ফাতিহা কুরআনের মূল, কিতাবের মূল এবং সালাতের মধ্যে বার বার তেলাওয়াত করা সাত আয়াতবিশিষ্ট সূরা। আর ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম’তার একটি আয়াত। (দারাকুতনী হা: ৩৬, সিলসিলা সহীহাহ হা: ১১৮৩)
দ্বিতীয় দলীল: বিষয় হল বর্তমান বিশ্বে কুরআনুল কারীমের নির্ভরযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য লিখিত কপি হল মদীনা মুনাওয়ারায় বাদশাহ ফাহাদ প্রিন্টিং প্রেস হতে মুদ্রিত কুরআনুল কারীম যা খলীফা উসমান (রাঃ) কর্তৃক সংকলিত কপির আদলে করা হয়েছে। সেখানেও বিসমিল্লাহ সূরা ফাতিহার প্রথম আয়াত হিসেবে রয়েছে। অতএব প্রমাণিত হয় “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম” সূরা ফাতিহার প্রথম আয়াত। আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।
“বিসমিল্লাহ” কিভাবে পড়তে হবে? সালাতে “বিসমিল্লাহ...” সশব্দে পড়ার স্বপক্ষে বিশুদ্ধ দলীল না থাকায় সঠিক নিয়ম হল “বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম” নিরবে পড়বে।
এটাই নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম), চার খলিফা ও সালাফদের থেকে প্রমাণিত। আনাস (রাঃ) বলেন: আমি নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম), আবূ বকর, উমার ও উসমান (রাঃ)-এর পেছনে সালাত আদায় করেছি। তাঁরা কিরাআতের আওয়াজ শুরু করতেন “আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন” দ্বারা। (সহীহ বুখারী হা: ৭৪৩)
অর্থাৎ কোন অবস্থাতেই “বিসমিল্লাহির রাহমানির রহীম” সরবে পড়তেন না। (সহীহ মুসলিম হা: ৩৯৯)
“বিসমিল্লাহ” এর ফযীলত:
১. রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যখন তোমাদের কোন ব্যক্তি বাড়িতে প্রবেশকালে ও খাবার গ্রহণ করার সময় আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করে অর্থাৎ “বিসমিল্লাহ” বলে, তখন শয়তান (তার সঙ্গীদের) বলে তোমাদের রাত্রি যাপন ও খাবার নেই। আর বাড়িতে প্রবেশকালে আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ করলে অর্থাৎ “বিসমিল্লাহ” না বললে শয়তান (তার সঙ্গীদের) বলে তোমরা রাত্রি যাপনের স্থান পেয়েছ এবং খাবার গ্রহণ করার সময় আল্লাহ তা‘আলাকে স্মরণ না করলে অর্থাৎ “বিসমিল্লাহ” না বললে শয়তান (তার সঙ্গীদের) বলে, রাত্রি যাপন ও খাবার উভয়টাই পেয়েছ। (আদাবুল মুফরাদ: ১/৪৩৩, সহীহ ইবনু মাযাহ হা: ৩৮৭৭, ইবনে হিব্বান হা: ৮১৯, সহীহ)। সুতরাং প্রত্যেক ভাল কাজের পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’বলা উচিত।
২. জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত, নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: ‘বিসমিল্লাহ’বলে তুমি তোমার দরজা বন্ধ কর। কারণ শয়তান বন্ধ দরজা খুলতে পারবে না। ‘বিসমিল্লাহ’বলে বাতি নিভিয়ে দাও, একটু কাঠখণ্ড দিয়ে হলেও ‘বিসমিল্লাহ’বলে পাত্রের মুখ ঢেকে দাও। (সহীহ বুখারী হা: ৩২৮০, সহীহ মুসলিম হা: ২০১২)
৩. আবূ সাঈদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যে ব্যক্তি ওযূ করার সময় بِسْمِ اللّٰهِ (বিসমিল্লাহ) পাঠ করে না, তার ওযূ হয় না। (আবূ দাঊদ হা: ১০১, ইবনু মাযাহ হা: ৩৯৭, সহীহ)
৪. কোন গুরুত্বপূর্ণ লেখনি, পত্র বা বাণীর শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’লেখা উচিত, কারণ এটা নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর নিয়ম ছিল। তিনি যখন রোমের বাদশাহ হিরাক্লিয়াসের কাছে ইসলামের দাওয়াত পত্র লেখেন তখন শুরুতেই লেখেন
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ مِنْ مُحَمَّدٍ عَبْدِ اللّٰهِ وَرَسُوْلِهِ
‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম’আল্লাহ তা‘আলার বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পক্ষ থেকে। (সহীহ বুখারী হা: ৭, সহীহ মুসলিম হা: ৪৫৮)
উল্লেখ্য যে, “বিসমিল্লাহ” এর পরিবর্তে ৭৮৬ লেখা অমুসলিমদের আবিষ্কার। তাই ৭৮৬ লেখা ও বলা বৈধ নয় বরং হারাম ও গুনাহের কাজ।
(اَلْحَمْدُ لِلہِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ)
‘সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।’কুরআনের শুরুতেই আল্লাহ তা‘আলা নিজেই নিজের প্রশংসা করেছেন। আর এরূপ নিজেই নিজের প্রশংসা করা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্যই সীমাবদ্ধ। প্রশংসা করা একটি ইবাদত যা শুধু আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য করতে হবে। এর অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
أَفْضَلُ الدُّعَاءِ اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ
সর্বোত্তম দু‘আ ‘আল-হামদুলিল্লাহ।’আল্লাহর প্রশংসা করা (তিরমিযী হা: ৩৩৪৩, সহীহ)
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন:
اَلْحَمْدُ لِلّٰهِ تَمْلَأُ الْمِيْزَانِ
‘আল হামদুলিল্লাহ (সওয়াবের) পাল্লা পূর্ণ করবে।’(সহীহ মুসলিম হা: ২২৩) বিশ্বজগতের সবাই আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلَهُ الْحَمْدُ فِي السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ)
‘আকাশ ও জমিনে তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা।’(সূরা রূম ৩০:১৮)
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(لَهُ الْحَمْدُ فِي الْأُوْلٰي وَالْاٰخِرَةِ)
‘দুনিয়াতে ও আখেরাতে তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা।’(সূরা কাসাস ২৮:৭০)
اللّٰهُ (আল্লাহ) হলেন বিশ্বজাহানের প্রতিপালক। “আল্লাহ” তাঁর সত্তাগত নাম। যাকে ‘ইসমে আযম’বলা হয়। তাঁর অন্যান্য নামগুলো এ নামের অনুগামী ও গুণবাচক নাম। এ নাম বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারো জন্য প্রযোজ্য নয়। এ নামের কোন ভাষায় কোন প্রতিশব্দ ও কোন পরিবর্তন নেই এবং এ নামের কোন দ্বিবচন বা বহুবচন নেই। সুতরাং ‘আল্লাহ’নামের অনুবাদ হিসেবে গড, ইশ্বর, ভগবান, খোদা ইত্যাদি বলা বা আল্লাহ তা‘আলাকে ঐ সব নামে নামকরণ করা বা ডাকা যাবে না।
আজকাল অনেককে দেখা যায় বিভিন্ন মাসজিদে, মাদরাসায়, বাড়িতে, গাড়িতে ইত্যাদি জায়গায় বরকতের জন্য এক পাশে আল্লাহ (اللّٰهُ) অপর পাশে মুহাম্মাদ (مُحَمَّد) লিখে রাখে। এটা নিঃসন্দেহে বিদ‘আত ও আল্লাহ তা‘আলার শানে বেআদবী। কেননা এরূপ পাশাপাশি ‘আল্লাহ ও মুহাম্মাদ’লেখা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে আল্লাহ তা‘আলার সমান মর্যাদায় স্থান দেয়ার শামিল, যা এক প্রকার শির্ক। সুতরাং এরূপ কখনো বৈধ নয়। রাসূলুল্লাহ বলেন:
لاَ تُطْرُونِي، كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَي ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللّٰهِ، وَرَسُولُهُ
খ্রিস্টানরা ইবনু মারইয়াম (ঈসা (আঃ))-কে নিয়ে যেমন বাড়াবাড়ি করেছে তোমরা আমাকে নিয়ে তেমন বাড়াবাড়ি করো না। আমি কেবল একজন আল্লাহর বান্দা। সুতরাং তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল হিসেবেই সম্বোধন কর। (সহীহ বুখারী হা: ৩৪৪৫)
কারো জিজ্ঞাসা হতে পারে
أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللّٰهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ
এখানে একই লাইনে اللّٰهُ ও مُحَمَّد নাম দু’টি রয়েছে তাহলে কি কালিমা শাহাদাতও ভুল?
উত্তর: আসলে কালিমা শাহাদাত বা আরো কোন কালিমায় একই লাইনে নাম দু’টি থাকলেও অর্থগত ও ভাবগত কোন সমস্যা নেই, বরং অর্থই স্পষ্ট করে দেয় যে, اللّٰهُ হলেন মা‘বূদ, আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। এমনকি দেখার সাথে সাথে দর্শক ও পাঠকের কাছে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। পক্ষান্তরে শুধু اللّٰهُ ও مُحَمَّد নাম দু’টি যখন উর্ধ্বে সমানভাবে লেখা হয়, তখন ভাবটা যেন এরূপ প্রকাশ হয় যে, আল্লাহ ও মুহাম্মাদ সমান স্থানের, সমান স্তরের এবং সমান মর্যাদার। এমনকি পাঠক ও দর্শক একইভাবে মনে করে ও পাঠ করে। কেউ কারো ঊর্ধ্বে নয়, দু’জনই সমান, নাউযুবিল্লাহ। সুতরাং এ ধরণের চিন্তা ও বিশ্বাস রাখা শির্ক। অতএব তা অবশ্যই বর্জনীয়। আমরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে অবশ্যই সকল মানুষের ঊর্ধ্বে স্থান দেব কিন্তু এর অর্থ এ নয় যে, তিনি আল্লাহর সমপর্যায়, নাউযুবিল্লাহ। আল্লাহ তা‘আলা হলেন সকলের ঊর্ধ্বে, তাঁর কোন সমকক্ষ নেই, তিনি এক ও অদ্বিতীয়। আর মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হলেন তাঁর বান্দা ও রাসূল, তাঁর সৃষ্টি জীব। তিনি মানুষের মাঝে শ্রেষ্ঠ কিন্তু কখনও আল্লাহ তা‘আলার সমপর্যায় নয়। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সঠিক অবস্থানে থাকার তাওফীক দান করুন, আমীন।
“رَبِّ الْعَالَمِيْنَ”
রব্বিল আলামীন- এটি আল্লাহ তা‘আলার গুণবাচক নাম:
رب শব্দের অর্থ: লালন পালন করা, কোন বস্তুর সকল কল্যাণের প্রতি লক্ষ রেখে পর্যায়ক্রমে সামনে এগিয়ে নিয়ে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেয়া।
আল্লাহ তা‘আলা যখন মূসা (আঃ)-কে ফির‘আউনের কাছে রবের দাওয়াত দেয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন, মূসা (আঃ) তার কাছে দাওয়াত পেশ করলে ফির‘আউন বলল:
(فَمَنْ رَّبُّكُمَا يٰمُوْسٰي)
‘হে মূসা তোমাদের প্রতিপালক কে?’(সূরা ত্বহা ২০:৪৯)
কারণ ফির‘আউন জানত আমিই মূসাকে লালন-পালন করেছি, ছোট থেকে বড় করেছি। তখন মূসা (আঃ) জবাবে বললেন:
(قَالَ رَبُّنَا الَّذِيْ أَعْطٰي كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَه۫ ثُمَّ هَدٰي)
‘‘আমাদের প্রতিপালক তিনি যিনি সকল বস্তুকে সৃষ্টি করেছেন অতঃপর পথপ্রদর্শন করেছেন।’’(সূরা ত্ব-হা ২০:৫০)
আর اَلْعَالَمِيْنَ শব্দটি عَالَمٌ এর বহুবচন, এতে সপ্ত আকাশ, সপ্ত জমিন ও উভয়ের মাঝে যা কিছু আছে সবই অন্তর্ভুক্ত। ফির‘আউন বলল:
(وَمَا رَبُّ الْعٰلَمِيْنَ)
‘‘রব্বুল আলামীন কে?’’জবাবে মূসা (আঃ) বলেন:
(قَالَ رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا)
‘‘আকাশ, জমিন ও উভয়ের মাঝে যা কিছু আছে সব কিছুর প্রতিপালক।’(সূরা শুয়ারা ২৬:২৩, ২৪) সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা আকাশ, জমিন ও মানবসহ সব কিছুর প্রতিপালক। তিনিই সব কিছুর একক স্রষ্টা, একক পালনকারী, একক পরিচালক ও একক অধিকারী, অন্য কেউ নয়।
এ আয়াত থেকেই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর তাওহীদের পরিচয় তুলে ধরেছেন। তাই তাওহীদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরা জরুরী।
তাওহীদের পরিচয়ঃ
তাওহীদ শব্দটি মুসলিম সমাজে একটি সুপরিচিত শব্দ হলেও এর সঠিক পরিচয় অনেকের কাছে অজানা। এজন্য বহু মুসলিম ব্যক্তি তাওহীদের বাণীর স্বীকৃতি দেয়া সত্ত্বেও তাওহীদ পরিপন্থী কর্মকান্ডে হাবুডুবু খাচ্ছে। আবার অনেকে তাওহীদের নামে সাধারণ মুসলিমদেরকে ধোঁকা দিচ্ছে।
তাওহীদ এর শাব্দিক অর্থ হলঃ
(جَعْلُ الشَّيْئِ وَاحِدًا)
অর্থাৎ কোন কিছুকে এক করে দেয়া। আল্লাহ তা‘আলাকে যাবতীয় শরীক হতে মুক্ত করে স্বীয় কর্তৃত্ব, গুণাবলী ও অধিকার এক করার নামই হল তাওহীদ।
তাওহীদ এর পারিভাষিক অর্থঃ নিম্ন বর্ণিত তিনটি বিষয় মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা, মৌখিক স্বীকৃতি প্রদান করা এবং বাস্তবে পালন করার নাম তাওহীদ:
১। সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টা, প্রতিপালক, মালিক ও পরিচালক একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা, অন্য কেউ নয়।
২। সৃষ্টি জীবের যাবতীয় ইবাদত বা উপাসনা একনিষ্ঠভাবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্যই সম্পাদন করা এবং অন্য সকল ব্যক্তি ও বস্তুকে ইবাদাতে আল্লাহ তা‘আলার শরীক না করা এবং সে সবের ইবাদত বা উপাসনা সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা।
৩। পবিত্র কুরআন এবং সহীহ হাদীসে আল্লাহ তা‘আলার যেসব সুন্দর নাম ও পবিত্র গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে সেগুলিকে কোন অপব্যাখ্যা, অস্বীকৃতি, বিকৃতি ও সাদৃশ্য স্থাপন ছাড়াই একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্যই খাসভাবে সাব্যস্ত করা। (সাবীলুল হুদা ওয়ার রাশাদঃ ১২ পৃষ্ঠা)
তাওহীদ নামে ধোঁকাঃ
তাওহীদ শব্দটি মুসলিম সমাজে একটি সুপরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসে যে তাওহীদের বর্ণনা এসেছে বা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যে তাওহীদ শিক্ষা দিয়েছেন উক্ত বর্ণনাই হলো সেই তাওহীদের আসল বর্ণনা। কিন্তু দুঃখের বিষয় মুসলিম নামধারী বিভিন্ন দল ও মত “তাওহীদ” শব্দটি ব্যবহার করে নিজেদের বাতিল মত ও পথ প্রচার করে যাচ্ছে। অতএব একজন সত্যাগ্রহী মুসলিম ব্যক্তিকে এ সকল ধোঁকা হতে সতর্ক থাকা অতি জরুরী। নিম্নে সংক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি দলের তাওহীদী মতবাদ তুলে ধরা হলোঃ
১। জাহমিয়া সম্প্রদায়ের তাওহীদঃ এ সম্প্রদায়ের নিকট তাওহীদ হল আল্লাহ তা‘আলার নাম, গুণাবলী ও অস্তিত্বকে অস্বীকার করা, শুধুমাত্র স্মৃতিতে আল্লাহ তা‘আলাকে মনে করাই হলো তাদের তাওহীদ।
২। চরমপন্থী সুফীবাদের তাওহীদঃ এ সম্প্রদায়ের নিকট তাওহীদ হল ওয়াহদাতুল উজুদ অর্থাৎ পৃথিবীর বুকে অস্তিত্বে যা পাওয়া যায় তা সবই আল্লাহ তা‘আলা। আকৃতিতে জিন, ইনসান, শুকুর ও কুকুর যাই হোক না কেন তা মূলত আল্লাহ তা‘আলারই উপস্থিতি। (নাউযুবিল্লাহ)
৩। মুতাযিলাদের তাওহীদঃ এ সম্প্রদায়ের নিকট আল্লাহ তা‘আলার যাবতীয় গুণাবলীকে অস্বীকার করার নামই হল তাওহীদ। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলীকে স্বীকার করে সে তাদের নিকট মুশরিক।
৪। আরেক দল মনে করে আল্লাহ তা‘আলাকে শুধু সৃষ্টিকর্তা হিসাবে স্বীকার করার নামই তাওহীদ।
৫। অপর আরেক দল মনে করে আল্লাহ তা‘আলাকে শুধু বিধানদাতা হিসেবে স্বীকার করার নামই তাওহীদ।
অতএব ইসলামের দাবীদার সকল দলই তাওহীদ এর দাওয়াত দেয় এবং তাওহীদ এর কথা বলে। কিন্তু নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তাওহীদ কতক দলের নিকট শির্ক, যেমনঃ জাহমিয়া, মুতাযিলা ও চরমপন্থী সুফীবাদের নিকট, আবার নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর শির্ক হল তাদের নিকট তাওহীদ। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর তাওহীদ বুঝার ও মেনে চলার তাওফীক দান করুন, আমীন।
তাওহীদের প্রকারভেদঃ
কুরআন বা হাদীসে তাওহীদ কত প্রকার ও কী কী তা সংখ্যায় উল্লেখ হয়নি। তবে কুরআনের আয়াতগুলোতে তাওহীদের অনুসন্ধান করে দেখলে পাওয়া যায় তাওহীদ তিন প্রকার। নিম্নে সংক্ষেপে প্রকারসমূহ প্রদত্ত হলঃ
১। تَوْحِيْدُ الرُّبُوْبِيَّةِ
তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ (প্রতিপালনে আল্লাহ তা‘আলার এককত্ব) : “সমগ্র সৃষ্টি জগতের স্রষ্টা, প্রতিপালক, পরিচালক, পূর্ণ ক্ষমতাশীল ও সার্বভৌমত্বের মালিক হিসেবে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলাকে স্বীকৃতি দেয়া ও মনে-প্রাণে বিশ্বাস করার নাম ‘তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ’। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(الْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ)
“সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য যাবতীয় প্রশংসা।” এ আয়াতে প্রথম প্রকার তাওহীদ অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বের স্রষ্টা, মালিক ও লালন-পালনকর্তা যে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা তার পরিচয় রয়েছে। সুতরাং তাঁরই আনুগত্য করা আমাদের একান্ত কর্তব্য।
২। تَوْحِيْدُ الْأُلُوْهِيَّةِ
তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ (ইবাদাতে আল্লাহর এককত্ব) : “যাবতীয় ইবাদাতের একক অধিকারী আল্লাহ তা‘আলা এটা বিশ্বাস করতঃ শুধু তাঁরই জন্য যাবতীয় ইবাদত সম্পাদন করার নাম ‘তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ’। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَآ اُمِرُوْٓا اِلَّا لِیَعْبُدُوا اللہَ مُخْلِصِیْنَ لَھُ الدِّیْنَﺃ حُنَفَا۬ئَ وَیُقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَیُؤْتُوا الزَّکٰوةَ وَذٰلِکَ دِیْنُ الْقَیِّمَةِﭔﺚ)
“তাদের শুধু এ নির্দেশই দেয়া হয়েছে যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে, সালাত কায়েম করবে এবং যাকাত আদায় করবে। এটাই সঠিক ধর্ম।”(সূরা বাইয়িনাহ ৯৮:৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
(إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِيْنُ)
“আমরা শুধু আপনারই ইবাদত করি এবং আপনারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি।”
৩। تَوْحِيْدُ الْأَسْمَاءِ وَالصِّفَاتِ
তাওহীদুল আসমায়ি ওয়াস সিফাত (নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে আল্লাহর এককত্ব) : পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসে আল্লাহ তা‘আলার যে সব সুন্দর নাম ও পবিত্র গুণাবলী বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর কোন বিকৃতি, অস্বীকৃতি, অপব্যাখ্যা, সাদৃশ্য স্থাপন এবং ধরণ-গঠন জিজ্ঞাসা ছাড়াই একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য সাব্যস্ত করা এবং এর প্রতি পূর্ণ ঈমান রাখার নাম “তাওহীদুল আসমায়ি ওয়াস সিফাত”। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَلِلہِ الْاَسْمَا۬ئُ الْحُسْنٰی فَادْعُوْھُ بِھَا)
“আল্লাহ তা‘আলার রয়েছে সুন্দর নামসমূহ তোমরা তা দ্বারাই তাঁকে ডাক।”(সূরা আরাফ ৭:১৮০) তিনি আরো বলেন:
(اَلرَّحْمٰنُ عَلَی الْعَرْشِ اسْتَوٰی)
“দয়াময় আল্লাহ আরশের উপর সমুন্নত।” (সূরা ত্বহা ২০:৫), তিনি আরো বলেন:
(الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ)
“যিনি পরম করুণাময়, অতিশয় দয়ালু।”ইত্যাদি।
তাওহীদের প্রয়োজনীয়তা: তাওহীদের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম যা বলার অপেক্ষা রাখেনা, সংক্ষিপ্ত পরিসরে কয়েকটি দিক আলোকপাতের মাধ্যমে তাওহীদের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হলঃ
১। সর্বপ্রথম ওয়াজিব তাওহীদ: তাওহীদ এমন একটি বিষয় যা ছাড়া কোন ব্যক্তির ঈমান সঠিক হতে পারেনা, বরং ঈমানের অপর নাম তাওহীদ। যাবতীয় ইবাদতের পূর্বে অবশ্যই তাওহীদ শিক্ষা ও পালন করা অপরিহার্য।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ)
“(সর্বপ্রথম) জ্ঞান অর্জন কর যে আল্লাহ ব্যতীত সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই। অতঃপর তোমার অপরাধের ক্ষমা প্রার্থনা কর।”(সূরা মুহাম্মদ ৪৭:১৯)
সুতরাং প্রথম ওয়াজিব হল তাওহীদ বা আল্লাহ তা‘আলার এককত্ব। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
بُنِيَ الْاِسْلَامُ عَلٰي خَمْسٍ شَهَادَةُ اَنْ لَّا اِلٰهَ اِلَّا اللّٰهُ
ইসলামের ভিত্তি হল পাঁচটি স্তম্ভের উপর, তন্মধ্যে প্রথম হলো সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত সত্যিকার কোন মা‘বূদ নেই। (সহীহুল বুখারী হা: ৮)
এরই নাম তাওহীদ। এ রুকন ছাড়া ইসলামে কোন ইবাদাতের মূল্য নেই অতএব প্রথম ওয়াজিব হল তাওহীদ বা আল্লাহ তা‘আলার এককত্ব মানা।
২। বান্দার উপর আল্লাহ তা‘আলার হক তাওহীদ : আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন কোন বিনিময় পাওয়ার জন্য নয়, আর মানুষও আল্লাহ তা‘আলাকে কোন বিনিময় দেয়ার ক্ষমতা রাখেনা। কিন্তু সৃষ্টি হিসাবে তার উপর স্রষ্টার হক রয়েছে। সহীহ বুখারীর হাদীসে এসেছে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মুয়াযকে (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি জানো বান্দার উপর আল্লাহ তা‘আলার হক কী? তিনি বললেনঃ আল্লাহ তা‘আলা এবং তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেনঃ
حَقُّ اللّٰهِ عَلَي الْعِبَادِ اَنْ يَّعْبُدُوْهُ وَلَايُشْرِكُوْبِهِ شَيْئًا
“বান্দার ওপর আল্লাহ তা‘আলার হক হল তারা একমাত্র তাঁর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবেনা।” অর্থাৎ তাঁর তাওহীদ পালন করাই হল বান্দার ওপর আল্লাহ তা‘আলার হক। (সহীহুল বুখারী হা: ১২৮)
৩। নবুওয়াতের অধিকাংশ সময় তাওহীদের দাওয়াত প্রদানঃ সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নাবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নবুওয়াতের ২৩ বছরের মধ্যে ১৩টি বছরই শুধু তাওহীদ এর ভিত্তি মজবুত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন। সুতরাং তাওহীদের প্রয়োজনীয়তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
৪। তাওহীদ ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ সম্ভব নয়ঃ মানুষ যতই ইবাদত করুক না কেন যদি তার তাওহীদ ঠিক না থাকে, তার মাঝে শির্ক স্থান পেয়ে যায় তাহলে নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
مَنْ لَقِيَ اللّٰهَ وَلَا يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ لَقِيَ اللّٰهَ وَيُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا دَخَلَ النَّارَ
যে ব্যক্তি কোনরূপ শির্কে লিপ্ত না হয়ে তাওহীদের উপর মারা যায় সে জান্নাতে যাবে, অপরপক্ষে যে শির্কে লিপ্ত হয়ে মারা যায় সে জাহান্নামে যাবে। (সহীহ মুসলিম হা: ৯৩)
৫। তাওহীদের বদৌলতে জাহান্নাম হতে মুক্তিঃ কিয়ামাতের ফায়সালার পর অপরাধী মু’মিন ব্যক্তি শাস্তি ভোগের জন্য জাহান্নামে যাবে। অতঃপর শাস্তি শেষে তাদের তাওহীদের বদৌলতে জাহান্নাম হতে আল্লাহ তা‘আলা মুক্তি দেবেন। নাবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: আল্লাহ তা‘আলা বলবেনঃ
وَعِزَّتِيْ وَجَلَالِيْ لِأَخْرُجَنَّ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ : لَا اِلٰهَ اِلَّا اللّٰهُ
আমার ইয্যাত ও সম্মানের কসম করে বলছি! যারা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু বলার মাধ্যমে শির্ক মুক্ত হয়ে তাওহীদের উপর রয়েছে আমি অবশ্যই তাদেরকে জাহান্নাম হতে বের করব। (সহীহ বুখারী হা: ৪৪, সহীহ মুসলিম হা: ৩২৬)
অতএব তাওহীদ ছাড়া ইসলাম গ্রহণ হতে পারে না, আর ইসলাম গ্রহণ ছাড়া জান্নাত পাওয়া যাবেনা। সুতরাং তাওহীদের প্রয়োজনীয়তা আর বলার আপেক্ষা রাখে না। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তাওহীদ জানা এবং মানার তাওফীক দান করুন। আমীন!
Nice
ReplyDelete