Skip to main content

ভ্রান্তি নিরসন

 ভ্রান্তি নিরসন


হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামের সামনে যে দ্বীন পেশ করেছিলেন, তা পরবর্তী উম্মতের নিকট পৌঁছানোর প্রধান দায়িত্ব পালন করেছেন সাহাবায়ে কিরাম রাযি.। সে হিসাবে সাহাবায়ে কিরাম রাযি. উম্মতের নিকট দ্বীন পৌঁছার মূলভিত্তি। তাঁদের পর এই দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তাবেঈন, তাবে তাবেঈন ও পর্যায়ক্রমে সমকালীন যুগের হক্কানী উলামায়ে কিরামের ওপর। আর সে জন্যেই ইসলাম বিদ্বেষীরা এসব মহামনীষীর পবিত্র চরিত্রকে কলুষিত করার জন্য বিভিন্ন রকমের ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিয়েছে। ইসলামের ইতিহাসকে বিকৃত করে তাদের চরিত্রে কালিমা লেপনের ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছে। সাহাবায়ে কিরাম রাযি. ও উলামায়ে কিরাম সম্পর্কে বিভিন্ন রকম ভিত্তিহীন অভিযোগ উত্থাপন করেছে। যাতে ইসলাম সম্পর্কে মানুষের মনে নানা রকম সন্দেহে-সংশয়ের সৃষ্টি হয় এবং ইসলাম প্রচারের মূলভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে যায়। তাই মুসলিম উম্মাহকে এরূপ ভ্রান্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে ‘ভ্রান্তি নিরসন’ নামে নিম্নে পৃথক তিনটি বিষয় সংযোজিত হলো।


ভ্রান্তি নিরসন-১:

সাহাবায়ে কিরামের ব্যাপারটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর। আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারায় (আয়াত ১৩ ও ১৩৭) সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য সাহাবায়ে কিরামকে দ্বীন ও ঈমানের কষ্টিপাথর ও নমুনা হিসেবে পেশ করেছেন। একটি হাদীসে তিনি ইরশাদ করেছেন-‘আমার সাহাবীগণ নক্ষত্র সমতুল্য’। এদের থেকে তোমরা যাকেই অনুসরণ করবে, হিদায়াত পেয়ে যাবে।’ [সূত্রঃ মিশকাত শরীফ খণ্ড ২, পৃষ্ঠা-৫৫৪]  


এ হাদীসটি শব্দের সামান্য পার্থক্য সহকারে অনেকগুলো সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। এসব সূত্রের মধ্য হতে কোনটির শুধু শব্দের ব্যাপারে কোন কোন মুহাদ্দিস কিছুটা আপত্তি করলেও তারা অর্থের ব্যাপারে কোন আপত্তি করেন নি। অথচ তাদের সে আপত্তিকে না বুঝে অনেকে এতদসম্পর্কে বর্ণিত সকল সূত্রকে বাতিল বলে প্রচার করে। এটা তাদের চরম মূর্খতা। কোন একটা সূত্রের উপর আপত্তির কারণে অবশিষ্ট সবগুলো সূত্র কখনো বাতিল হতে পারে না। তেমনিভাবে অবশিষ্ট সূত্রে প্রাপ্ত হাদীস সমূহও বানোয়াট হওয়া প্রমাণিত হয় না।


যা হোক, নমুনাস্বরূপ কয়েকটি আয়াত ও হাদীস ও পেশ করা হয়েছে, যার সারমর্ম হলো, সাহাবীগণ সত্যের মাপকাঠিস্বরূপ। তারা কিয়ামত পর্যন্ত আগমনকারী সকল মানুষের জন্যে পথপ্রদর্শক ও আদর্শ। ঈমানের সাথে একবার যিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখেছেন, এবং ঈমানের সাথেই ইনতিকাল করেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত সকল ওলী-বুযুর্গ মিলে তার সমতুল্য হবেন না। সুতরাং, এর দ্বারাই বোঝা যায় যে, তাদের মর্যাদা কত অধিক!


অপরদিকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা বা তাদের সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব পোষণ করা কিংবা তাদের বিরূপ সমালোচনা করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। এমনকি তিনি বলেছেন- “আমার সাহাবীগণের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় করো।” আমার ইনতিকালের পর তোমরা তাদেরকে সমালোচনার পাত্র বানিও না। কেননা, যে ব্যক্তি তাদেরকে ভালোবাসবে, সে প্রকৃতপক্ষে আমাকে ভালোবাসার কারণেই তাদেরকে ভালোবাসবে। আর যে ব্যক্তি তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে, সে প্রকৃতপক্ষে আমার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করার কারণেই তাদের প্রতি বিদ্বেষ করবে। যে ব্যক্তি তাদেরকে কষ্ট দিল, সে আমাকে কষ্ট দিল। আর যে আমাকে কষ্ট দিল, সে আল্লাহ তা‘আলাকে কষ্ট দিল। আর যে আল্লাহ তা‘আলাকে কষ্ট দিল, তার গ্রেফতারী অতি নিকটেই। [সূত্র: মিশকাত শরীফ খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৫৪।]


এর দ্বারা বোঝা যায়, সাহাবীগণের সমালোচনার করা কত বড় মারাত্মক অপরাধ! যে ব্যক্তি সাহাবীগণের সমালোচনার করলো, সে এটা প্রমাণ করে দিল যে, তার অন্তরে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর প্রতি বিদ্বেষ আছে। আর সেটার বহিঃপ্রকাশের জন্যেই সে সাহাবীগণের সমালোচনার পথ বেছে নিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা সকলকে হেফাজত করুন।


অপর একটি হাদীসে নবী পাক সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- “তোমরা যখন কাউকে সাহাবীগণের সমালোচনা করতে দেখ, তখন বলে দাও যে, তোমাদের ও সাহাবায়ে কিরামদের মধ্যে যারা নিকৃষ্ট, তাদের ওপর অর্থাৎ সমালোচনাকারীদের ওপর আল্লাহর লানত।” 


পাঠকবৃন্দ! লক্ষ্য করুন, একদিকে সাহাবায়ে কিরাম সত্যের মাপকাঠি। অপরদিকে তাদের সমালোচনা করা হারাম, অনেক ক্ষেত্রে কুফরও বটে। আর তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা ও ভালোবাসা ঈমানের অংশ। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কথাগুলো তাদের মাধ্যমেই উম্মতের নিকট এসে পৌঁছেছে। এসব দিক লক্ষ্য করেই উলামায়ে কিরাম সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, যে ইতিহাস মানুষ কর্তৃক রচিত, এর মধ্যে আবার অনেকগুলোই ইসলামের দুশমনদের দ্বারা লিখিত। সুতরাং, এসব ইতিহাস নির্ভর তথ্যের ওপর যাচাই-বাছাই ছাড়া পরিপূর্ণরূপে বিশ্বাস করা অসম্ভব। তাই ইতিহাসের যে অংশটুকু কুরআন ও সুন্নাহর সাথে সংঘাতপূর্ণ নয় এবং সাহাবায়ে কিরামের মর্যাদার সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল, শুধুমাত্র ততটুকুই গ্রহণ করা হবে। অবশিষ্ট অংশ কোনক্রমেই গ্রহণ করা হবে না। 


ঈমান-আকীদার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একমাত্র এরই ওপর পরকালে মানুষের নাজাত ও মুক্তি নির্ভরশীল। সুতরাং, ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে ঈমানের ওপর আচড় আসতে দেওয়া কোন জ্ঞানী লোকের পক্ষে শোভা পায় না। ফলতঃ সাহাবীগণ নির্ভরযোগ্য গণ্য না হলে সম্পূর্ণ দ্বীনের বুনিয়াদই নষ্ট হয়ে যায়। কারণ আমরা দ্বীন পেয়েছি সাহাবীগণের মাধ্যমেই।  


কেউ বলতে পারেন, বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে হযরত মা‘য়িম রাযি.এর দ্বারা যিনা সংঘটিত হওয়া এবং তাকে পাথর মেরে হত্যা করার ঘটনা উল্লেখ আছে। তেমনিভাবে অপর এক সাহাবীর মদ্যপান এবং তাকে শাস্তিদানের কথা উল্লেখ আছে। আর উভয় ঘটনাই সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। তাহলে সাহাবীগণ কীভাবে সত্যের মাপকাঠি হতে পারেন? তাছাড়া তাদের দ্বারাই তো সংঘটিত হয়েছে জংগে জামাল, জংগে সিফফীন এর ন্যায় ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ। তাহলে তাদেরকে কিভাবে সত্যের মাপকাঠিরূপে মেনে নেওয়া যায়? তাদের এরূপ মন্তব্যের উত্তরে উলামায়ে কিরাম বলেনঃ


ক. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মতো সাহাবীগণ মাসুম বা নিষ্পাপ নন। তবে দ্বীনের জন্যে অকল্পনীয় ত্যাগ ও কুরবানীর কারণে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাদের মাগফিরাত ও জান্নাত প্রদানের কথা ঘোষণা করেছেন। [সূত্র: সূরা তাওবা, আয়াত -১০০।] 


সুতরাং , তারা মাসুম না হলেও নিঃসন্দেহে তারা মাগফিরাত প্রাপ্ত ও জান্নাতী। তাই পরবর্তীদের জন্যে শুধ তাদের ভালো আলোচনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে; সমালোচনার অনুমতি কোনক্রমেই দেওয়া হয়নি। এর কারণ অত্যন্ত স্পষ্ট। প্রত্যেকে নিজের দিকে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবে যে, সে দ্বীনের জন্যে কতটুকু কুরবানী করেছে। নিজেকে কতটুকু গুনাহ থেকে বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রতি নিয়ত যে ব্যক্তি ভুল করেই চলেছে, তার জন্য কি মাগফিরাত প্রাপ্ত জান্নাতী মনীষীবৃন্দের সমালোচনা করা শোভা পায়? দ্বীন বুঝতে বা কায়িম করতে কি এ ধরণের আলোচনার কোন প্রয়োজন পড়ে? আর যদি তা না-ই হয়, তাহলে কোন প্রয়োজনে তারা নিষিদ্ধ কাজে লিপ্ত হলো? সমুদ্রে নাপাক পড়লে, পেশাব পড়লে যেমন সমুদ্র নাপাক হয় না, বরং নাপাক তার অস্তিত্ব হারিয়ে বিলীন হয়ে যায়, তেমনি সাহাবীগণ তাদের অসাধারণ কুরবানীর বদৌলতে ছিলেন নেকীর সমুদ্র। সুতরাং তাদের দু’একজনের জীবনে যদি অসাবধানতা বশত দু’একটি গুনাহ সংঘটিত হয়ে যায়, তাহলে সে কারণে তাদের সমগ্র জীবনের কুরবানী থেকে চক্ষু বন্ধ করে তাদের সমালোচনা করা কোনক্রমেই বৈধ হতে পারে না। 


খ. লক্ষাধিক সাহাবায়ে কিরামের রাযি. মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন যদি কোন গুনাহ করে ফেলেন, তাহলে তাতে কি এ বিশাল জামাতের ওপর কোন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে ‍পারে এবং তাতে কি তাদের সত্যের মাপকাঠি ও উম্মতের পথপ্রদর্শক হওয়া বাতিল হয়ে যায়? দু’একজন থেকে যে ভুল হয়েছে, তাতো হাদীসে ভুল হিসেবে বা গুনাহ হিসেবে চিহ্নিতই করা হয়েছে। সুতরাং সেই ভুলের বিষয়ে তাদেরকে অনুকরণ বা অনুসরণের তো কোন প্রশ্নই উঠে না। আর এরূপ একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনার মধ্যে তো কত হিকমত নিহিত রয়েছে, তা আল্লাহ তা‘আলাই ভালো জানেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়াতে প্রেরণ করা হয়েছিল শুধু আল্লাহর আহকাম বর্ণনা করার জন্য নয়; বরং প্রত্যেক আহকামের বাস্তবরূপ উম্মতকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। তাই খোদা না করুন, যদি কোন রাষ্ট্রে ইসলামী হুকমত কায়িম থাকা অবস্থায় কোন ব্যক্তির থেকে যিনা বা মদপানের অপরাধ সংঘটিত হয়ে যায়, তা প্রমাণ করার পদ্ধতি এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে তার শাস্তি প্রয়োগের নিয়ম কি হবে, এটা উম্মতের সামনে আসার জন্য এরূপ দু’একটি ঘটনা পথ নির্দেশনারই শামিল। তাছাড়া একজন মুমিন থেকে যদি ভুলক্রমে বা শয়তানের প্রবঞ্চনায় গুনাহ হয়ে যায়, তখন সেই ঈমানদারদের মানসিক অবস্থা কিরূপ হওয়া উচিত, এবং গুনাহ থেকে নিজেকে পাক-পবিত্র করার জন্যে কতটুকু পেরেশান হওয়া উচিত, এরও একটা নমুনা সেই ঘটনাসমূহ দ্বারা স্থাপিত হয়েছে। সেদিকে লক্ষ্য করলে এরূপ দু’একটি ঘটনার হিকমত বোঝা যায় এবং একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, ঐ ভুলের ব্যাপারে উম্মত তাদের অনুকরণ করবে না বটে, কিন্তু ঐ অবস্থায় তার মানসিক অবস্থা ও খোদার প্রতি ভয়-ভীতি কিরূপ প্রকাশ পাওয়া উচিত, সে ব্যাপারে উক্ত সাহাবী তার জন্যে দৃষ্টান্ত এবং অনুকরণীয় হবেন। সুবাহানাল্লাহ! আল্লাহর কাজের মধ্যে কত হিকমত থাকতে পারে! হযরত মা‘য়িয রাযি. থেকে যিনা হওয়ার পর তিনি নিজেই নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে এসে বললেন ‘হে আল্লাহর নবী! আমি ধ্বংস হয়ে গেছি । আমাকে পবিত্র করুন!’ অথচ তিনি নিজে না বললে এ ঘটনা প্রকাশ পেত না। একমাত্র খোদার ভয়ে তিনি এত পেরেশান হয়েছিলেন যে, নিজেকে পাক-পবিত্র করার জন্যে নিজেই অপরাধ স্বীকার করেছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন মা‘য়িয তুমি হয়তো তাকে স্পর্শ করেছ বা চুমো দিয়েছ? তিনি বললেন-না, আমি যিনাই করে ফেলেছি। চারবার স্বীকারোক্তির পর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সঙ্গেসার করার বা পাথর মেরে হত্যা করার নির্দেশ দিলেন। তিনি অপরাধ করেছিলেন এ কথা ঠিক, কিন্তু তারপরও তিনি আমাদের ন্যায় অপরাধকারী সকল উম্মতের জন্যে গুনাহ মাফ করানোর ব্যাপারে নমুনা বা আদর্শ হয়ে আছেন। 


গ. সাহাবা রাযি. কর্তৃক জংগে জামাল, জংগে সিফফীন সংঘটিত হয়েছিল- একথা ঠিক, কিন্তু কেউ কি বলতে পারবে যে, তারা ক্ষমতা দখলের জন্য বা দুনিয়াবী কোন স্বার্থে এসব যুদ্ধ করেছিলেন? এ সম্পর্কে যাদের যথার্থ জ্ঞান রয়েছে, তারা সকলেই স্বীকার করবেন যে, উভয় জামা‘আতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর বিধান কায়িম করা। আর এ জন্যে তারা সাধ্যমতো প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু সাহাবীগণের উভয় জামা‘আতের মাঝে মুনাফিক ‘আবদুল্লাহ বিন সাবা’র বাহিনী এমনভাবে ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে রেখেছিল, যা থেকে পরিত্রান পাওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার। এই ক্ষুদ্র পরিসরে সে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। সারকথা, সাহাবীগণের উভয় দলের মধ্যে কোন দলই দুনিয়াবি স্বার্থে এসব যুদ্ধ করেন নি। উভয় দলেরই উদ্দেশ্যই ছিল দ্বীন। আপাতদৃষ্টিতে একদলের সিদ্ধান্ত সঠিক মনে হলে, অপর দলের সিদ্ধান্তকে ভুল বলে সমালোচনা করা যাবে না। কারণ এটা ভুল গণ্য হলেও তা ছিল ইজতিহাদী ভুল-যা ক্ষমার্হ। এ কারণে উভয় জামা‘আত থেকে যারা সেসব যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, তাদের সকলকে শহীদ বলা হয় এবং বহু বছর পর বিশেষ কারণে যখন তাদের কবর খনন করা হয়, তখন তাদের লাশ সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়। [সূত্র : আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ২৫৯।] কুরআন ও হাদীসের দৃষ্টিতে এটা শাহাদাতের আলামত। তাদের এই শাহাদত প্রমাণ করে যে, তারা দুনিয়ার লোভে এসব যুদ্ধ করেন নি। বরং দ্বীনের জন্যে করেছিলেন।


এখানে একটি কথা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, এসব ঘটনা আল্লাহ তা‘আলার ইলমে অবশ্যই ছিল এবং সামনে রেখেই তিনি সাহাবীগণের ব্যাপারে রাজি হওয়ার এবং তাদের জান্নাতী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এরপরও আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে সেই মহান সাহাবীগণের সমালোচনা ও দোষচর্চার কি অধিকার থাকতে পারে? প্রত্যেকে যদি নিজের দোষ সংশোধনের চিন্তা করে, তাহলে কেউ এমন মহান ব্যক্তিবর্গের দোষচর্চা তো দূরের কথা, একজন সাধারণ ও নিম্নস্তরের মুসলমানের দোষচর্চায়ও লিপ্ত হতে পারে না। উপরন্তু এরূপ আলোচনা ‘গীবত’ হওয়ার কারণে শরী‘আতের দৃষ্টিতে হারাম। যারা নিজের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন, নিজের ঈমান-আকীদার খবরও যাদের কাছে নেই, তারাই এরূপ হারামে লিপ্ত হওয়ার দুঃসাহস দেখাতে পারে।


প্রত্যেক নিজের বাপ-দাদার ব্যাপারে কত হুঁশিয়ার! কেউ তার বাপ-দাদার অন্যায় সমালোচনা বরদাশত করতে পারে না। অথচ সাহাবীগণের ইজ্জত-আব্রু সংরক্ষণ করা আমাদের পিতা-মাতা ও দাদা-নানার ইজ্জত-আব্রু সংরক্ষণের চেয়েও লক্ষ-কোটি গুণ বেশি জরুরী। মুসলমান হয়েও কিভাবে সাহাবীগণের দোষচর্চা করতে পারে, বা দোষচর্চা শুনে বরদাশত করতে পারে, তা বোধগম্য নয়। 


ভ্রান্তি নিরসন-২:

বর্তমানে অনেক নব্যশিক্ষিত লোক আলেম সমাজের বিরুদ্ধে বুঝে না বুঝে তাদের গুরুদের অনুকরণে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপন কর সমালোচনা করে থাকে। অথচ উলামায়ে কিরাম দ্বীনের কাজ করছেন, তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ওয়ারিশ, তাই তাদেরকে গালি দেওয়া, তাদেরকে হেয় করা, তাদের সমালোচনা করা শরী‘আতের দৃষ্টিতে কুফরী কাজ। এতে ঈমান চলে যায়। আর ঈমান চলে গেলে অতীত জীবনের সমস্ত নেক আমল বরবাদ হয়ে যেতে পারে, বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যেতে পারে। মৃত্যুর পর কবরে তাদের চেহারা কিবলার দিক থেকে আপনা আপনি অন্য দিকে ফিরে যাবে বলে হাদীসে এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা সকলকে হেফাযত করুন। 


তাদের সেই অভিযোগ মূলত ভ্রান্তিপ্রসূত। সেই ভ্রান্তি নিরসনে তাদের উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযোগের জবাব নিম্নে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আমরা অভিযোগগুলো উল্লেখপূর্বক তার জবাব এজন্যে প্রদান করছি, যাতে করে তাদের অভিযোগের যবনিকাপাত হয় এবং এরদ্বারা আলেম সমাজের দোষারোপ করা থেকে দূরে থেকে সরল প্রাণ মুসলমানগণ নিজেদের ঈমান বাঁচাতে পারেন।


প্রথম অভিযোগঃ

তারা অভিযোগ করে, উলামায়ে কিরাম মাদরাসার মধ্যে শুধু কুরআন-হাদীস কেন শিক্ষা দেয়? এর সাথে বিভিন্ন রকম কারিগরি বা হস্ত শিল্প ইত্যাদি শিক্ষা দিতে তাদের বাধা কোথায়?


জবাবঃ

অভিযোগকারীরা মূলত কওমী মাদরাসায় শিক্ষার লক্ষ্যে-উদ্দেশ্যে সম্পর্কে বে-খবর। এজন্য তাদের মধ্যে এই আপত্তি উঠেছে। তাহলে শুনুন, দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক দ্বারা পরিচালিত না হলে দুনিয়াতে কোন জিনিসই ভালোভাবে টিকে থাকতে পারে না। বরং কিছুদিন পরেই তা বিলুপ্ত হয়ে যায়।। দ্বীন ইসলাম মানবজাতির জন্যে আল্লাহর পক্ষ থেকে দুনিয়াও আখিরাতের কামিয়াবির জন্যে সবচেয়ে বড় নেয়ামত । সুতরাং, এ নেয়ামতের স্থায়িত্বের জন্যে প্রত্যেক জামানায়, প্রত্যেক এলাকায় বিজ্ঞ ও পারদর্শী হক্কানী উলামায়ে কিরামের বড় একটি জামাত বিদ্যমান থেকে সহীহভাবে দ্বীনের সকল বিভাগে খিদমত আনজাম দেওয়া জরুরী। কওমী মাদরাসারগুলোর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো, মুসলিম মিল্লাতের এ দ্বীনি দায়িত্ব ও চাহিদা পূরণের জন্য হক্কানী ও আল্লাহওয়ালা বিজ্ঞ উলামা দল সৃষ্টি করা, যাতে দ্বীন ইসলামের স্থায়িত্ব ও প্রচার প্রসারে এবং মুসলমানদের দ্বীনি প্রয়োজন মিটাতে কোন ক্ষেত্রে কোন রকম সমস্যার সৃষ্টি না হয়। আল-হামদুলিল্লাহ, এ লক্ষ্যে একনিষ্ঠভাবে কওমী মাদরাসাসমূহ নীরব আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে এবং তারই বদৌলতে চরম ফিতনার এ যুগে এখনো মুসলমানগণ সহীহ দ্বীন- ঈমান নিয়ে টিকে আছেন। এখন যদি কওমী মাদরাসাসমূহের সিলেবাসে হস্তশিল্প, কারিগর প্রশিক্ষণ প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে আর বিজ্ঞ পারদর্শী উলামা সৃষ্টি হবে না। যেমন সরকারী মাদরাসা থেকে হচ্ছে না এবং এটা কখনো সম্ভব নয়। কারণ, কুরআন হাদীসের জ্ঞান অত্যন্ত সূক্ষ্ণ ও সুগভীর। প্রখর ছাত্র যদি একনিষ্ঠভাবে এই জ্ঞান অধ্যয়ন করে, তাহলে সে এটা আয়ত্তে আনতে পারবে। কিন্তু দ্বীনি ইলমের সাথে দুনিয়াবি বিষয়ের মিশ্রণ ঘটালে, তার পক্ষে আর কোনভাবেই এটা সম্পূর্ণরূপে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। কথায় বলে, ‘তোলা দুধে পোলা বাঁচে না।’ সুতরাং তখন যেসব নামকে ওয়াস্তে আলেম তৈরী হবে, তাদের দ্বারা দ্বীন ইসলাম টিকে থাকবে না এবং তাদের থেকে জনগণ সহীহ দ্বীনও পাবে না। তাই দ্বীন রক্ষার স্বার্থেই কওমী মাদরাসা কুটির শিল্প, কারিগরি প্রশিক্ষণ প্রভৃতি প্রবেশ করানো হয় না। 


বিষয়টি আরো পরিষ্কার করে বোঝাবার জন্যে অভিযোগকারীদের নিকট আমাদের প্রশ্ন যে, আপনারা এ ধরণের প্রস্তাব কেন দিচ্ছেন না যে, মেডিকেল কলেজে শুধু ডাক্তার তৈরী করা হচ্ছে কেন? সেখানে কিছু কমার্সের সাবজেক্টও ঢুকানো হোক। যাতে তাদের মধ্যে দু ধরণের যোগ্যতা সৃষ্টি হয়। তেমনিভাবে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ- ইউনিভার্সিটিগুলোতে মেডিকেল সায়েন্স প্রবেশ করানো হোক। যাতে করে তারা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সাথে সাথে ডাক্তারও হতে পারে। ফলে তারা জাতির জন্যে দ্বিগুণ খিদমত আনজাম দিতে পারবে।


আজ পর্যন্ত কোন পাগলও এ ধরণের চিন্তা করেছি কি? নিশ্চয়ই নয় কারণ কী? কারণ এটাই যে, এতে দুটোর কোনটাই ভালোভাবে শিক্ষা লাভ করা যাবে না। তাহলে মাদরাসার ব্যাপারে আপনাদের এ ধরণের বেওকুফি প্রস্তাব কেন?


আসল কথা হচ্ছে, সেই অভিযোগকারীরা দ্বীনি ইলমের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে না। জেনে রাখুন, সকলের জন্য ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়া জরুরী নয়; কিন্তু প্রয়োজনীয় ইলমে দ্বীন শিক্ষা করা প্রত্যেকের ওপর ফরয। প্রত্যেক মুসলিম ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও অর্থনীতিবিদের জন্য ইলমে দ্বীন শিক্ষা করা ফরয। কিন্তু কোন আলেমের জন্যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়া জরুরী নয়, বরং এটা সমীচীনও নয়। কারণ দুই লাইনের খিদমত কেউ কখনো একসঙ্গে আনজাম দিতে পারবে না। যে কোন একটা পূর্ণভাবে পাঠ করলে, অন্যটা বাদ পড়তে বাধ্য। সুতরাং উলামায়ে কিরামকে এ ধরণের অনর্থক পরামর্শ না দিয়ে তারা যদি স্কুল-কলেজে গিয়ে সেখানকার সিলেবাসে ফরযে আইন পরিমাণ ইলমে দ্বীন শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দেন তাহলে সেটা হবে সত্যিকার অর্থে মুসলিম জাতির কল্যাণ কামনা। তাতে মুসলিম ছেলেদের দ্বীন ও ঈমানের হেফাযত হবে। মুসলিম সন্তানরা খৃষ্টানী ও হিন্দুয়ানী কৃষ্টি-কালচারে প্রভাবিত বা প্ররোচিত না হয়ে ইসলামের দিকেই ধাবিত হতে থাকবে। বর্তমানে যে মুসলমান ও হিন্দু, মুসলমান ও খৃষ্টান, মুসলমান ও নাস্তিকের মাঝে হারামভাবে বিয়ে-শাদী হচ্ছে, তা দ্বীনি ইলম বিবর্জিত ভ্রান্ত শিক্ষানীতিরই কুফল। কোন জাতির শিক্ষানীতি যদি ভ্রান্ত হয় এবং শিক্ষার নামে কুশিক্ষা চলতে থাকে, তাহলে সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য। তাই জাতিকে সেই ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে সচেষ্ট হোন এবং উলামায়ে কিরাম সম্পর্কে অযৌক্তিক চিন্তাধারা পরিত্যাগ করুন। 


দ্বিতীয় অভিযোগঃ

আলেমগণ শুধু মসজিদ, মাদরাসা, খানকাহ আর ওয়াজ-নসিহত নিয়ে ব্যস্ত থাকেন কেন? তারা কি জাতির জন্যে কিছু খিদমত আনজাম দিতে পারে না? তারা ইচ্ছা করলে বিভিন্ন অফিস-আদালতে ব্যবসা-বাণিজ্যে, মিল-ফ্যাক্টরীতে শ্রম দিতে পারতেন! তাতে জাতির অনেক উপকার হতো। 


জবাবঃ

কিছু লোক কওমী মাদরাসায় পড়ে দ্বীনি লাইনে পারদর্শী হয়েছেন, আলেম হয়েছেন, তেমনি আরো কিছু লোক জেনারেল লাইনে পড়ে পারদর্শী হয়ে কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ অর্থনীতিবিদ ইত্যাদি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এখন কি কেউ প্রশ্ন তুলবে যে, ডাক্তাররা শুধু হাসপাতালে আর ক্লিনিকে কেন ব্যস্ত থাকবে? তারা ব্যবসা-বাণিজ্যে, মিল-কারখানায় শ্রম দিলে তো জাতির অনেক উপকার হতো! নিশ্চয়ই এই প্রশ্ন কেউ করবে না। কারণ, ডাক্তার এই কাজ শুরু করলে জাতি বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। ঠিক তেমনিভাবে উলামায়ে কিরাম যদি মিল-ফ্যাক্টরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করেন, তাহলে জাতি বিনা হিদায়াতে ঈমানহারা হবে। তারা ইলমে দ্বীনের সেবা থেকে বঞ্চিত হলে, নিঃসন্দেহে বিপথগামী হয়ে জাহান্নামের পথে অগ্রসর হবে। জাতিকে সেই ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতেই আলেম-উলামাগণ দ্বীনের যিম্মাদারী নিয়ে ব্যস্ত আছেন।


তদুপরি আলেমগণ জাগতিক উন্নতির মাধ্যমও বটে। কারণ, একটি হাদীসে পাকের সারকথা হলো. ‘কিছু লোক যে দ্বীন শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেওয়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন, তাদেরকে উসিলা করে আল্লাহ তা‘আলা সকলকে প্রতিপালন করছেন ‘অন্য এক হাদীসের সারমর্ম হলো, ‘আলেম ও তালেবে ইলমের মাধ্যমে দ্বীন টিকে থাকার ওপরই জগতের স্থায়িত্ব নির্ভরশীল।’ বলা বাহুল্য, আলেম-উলামা ও তালিবে ইলমদের দ্বীনি খিদমতের বদৌলতেই আল্লাহ তা‘আলা জমিনে ফসল দিচ্ছেন, ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় বরকত দিচ্ছেন, কল-কারখানায় উন্নতি দান করছেন। এক কথায় চীন, রাশিয়া, জাপান, জার্মান, ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ সারা বিশ্ব টিকে আছে উলামায়ে কিরামের দ্বীনি খিদমতের উসিলায়। যেদিন এ দ্বীনি খিদমত বন্ধ হয়ে যাবে, সেদিন দুনিয়া আর টিকে থাকবে না। বরং সেদিন মহাপ্রলয় বা কিয়ামত সংঘটিত হয়ে সব ধুলিস্যাৎ হয়ে যাবে।


তাছাড়া আরো লক্ষ্য করুন, সংসদ সদস্যগণ মিল-ফ্যাক্টরীতে যোগদান করলে যেমন দেশ চলবে না, তেমনিভাবে উলামায়ে কিরাম জনগণের দ্বীনি খিদমত বাদ দিয়ে দুনিয়াবি কাজে লাগলে দুনিয়াও অচল হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। যারা মুসলমান, কুরআন-হাদীস স্বীকার করেন, তাদের সম্বিৎ ফেরাবার জন্যে আমরা এসব কথা পেশ করলাম। শরী‘আতের বিরুদ্ধাচরণকারী অবাধ্য নাস্তিক-মুরতাদের সাথে আমাদের কোন তর্ক-বিতর্ক নেই। 


তৃতীয় অভিযোগঃ

আলেম সমাজ পরজীবী হয়ে বেঁচে থাকা পছন্দ করেন কেন? তারা ব্যবসা-বাণিজ্যে বা দুনিয়াবী অন্য কোন পেশা অবলম্বন করে আত্মনির্ভরশীল হয়ে চলতে পারেন না? 


জবাবঃ

দুনিয়াবি শিক্ষায় পারদর্শী ও বড় বড় ডিগ্রিধারী লোকেরা অনেক শ্রম, সময় ও পয়সা ব্যয় করে বিভিন্ন লাইনে পারদর্শী হয়ে সেই লাইনে জাতির সেবা করছেন এবং জাতির নিকট থেকে তার বিনিময় গ্রহণ করে তার দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করছেন। এটাই সমগ্র বিশ্বের একটা সাধারণ নিয়ম। প্রত্যেকে তার লাইন অনুযায়ী জাতিকে সেবা করে বিনিময় গ্রহণ করবেন-এর মধ্যে দোষের কিছু নেই এবং এ জন্যে যারা নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, তাদেরকে কেউ পরজীবী বলে না। তাহলে প্রশ্ন হলো, উলামায়ে কিরাম সর্বাধিক গুরুত্বপুর্ণ বিষয়ে পারদর্শিতা অর্জন করেছেন এবং তাদের দক্ষতা অনুযায়ী জনগণের দ্বীনি সেবা ও খিদমতের জন্যে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, এর বিনিময় হিসাবে জনগণ থেকে হালালভাবে কোন পারিশ্রমিক গ্রহণ করলে, কেন তাদেরকে পরজীবী বলা হবে? কওম ও জাতির পক্ষ থেকে এটা কি আলেম সমাজের প্রতি দয়া বা করুণা? তারা কি জাতির কম গুরুত্বপূর্ণ খিদমত আনজাম দিচ্ছেন? নাকি অল্প পরিশ্রমে অধিক বিনিময় গ্রহণ করছেন? বরং আলেমগণ জাতির বিরাট খিদমত আনজাম দিচ্ছেন। দুনিয়াও আখিরাতের কল্যাণের রাস্তা একমাত্র উলামায়ে কিরামই দেখাচ্ছেন। মানুষকে তারা জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে জান্নাতের যোগ্য হওয়ার পথ প্রদর্শন করেছেন। তাছাড়া দুনিয়াতে এখনো লজ্জা-শরম বিবাহ-শাদী, পাক-পবিত্রতা, আমানতদারি-সততা যতটুকু বিদ্যমান আছে, তা একমাত্র উলামায়ে কিরামেরই অবদান। এর চেয়ে বড় খিদমত আর কি হতে পারে? এর তুলনায় অন্যদের যতরকম ক্ষণস্থায়ী ও নগণ্য খিদমতের কতটুকু মূল্য আছে? উলামায়ে কিরাম যথেষ্ট শ্রম দিয়ে কেবলমাত্র জীবনধারণ উপযোগী স্বল্প পারিশ্রমিক গ্রহণ করছেন। তাঁরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার শিক্ষকদের তুলনায় অতি সামান্য বিনিময় নিয়ে থাকেন। তারপরও অযথা এ আপত্তি কেন? আলেমগণের সম্পর্কে এ ধরণের অভিযোগ উত্থাপন জাতির জন্যে বড়ই পরিতাপের বিষয়। এর দ্বারা দ্বীনের কাজের গুরুত্বকে ছোট নজরে দেখা হয়, যা ঈমানের জন্যে ক্ষতিকর। আল্লাহ তা‘আলা সকলকে সহীহ ও সঠিক বিবেক বুদ্ধি দান করুন।


ভ্রান্তি নিরসন-৩:

অনেকে বলে থাকে যে, শুনেছি, হাদীসে আছে, আল্লাহ তা‘আলার দরবারে দু’টি কিতাব বা দফতর আছে। তার একটির মধ্যে শুধু জান্নাতীদের নাম আছে। আর অপরটির মধ্যে আছে জাহান্নামীদের নাম এবং উভয় খাতার নামগুলো যোগ করে মোটসংখ্যা নির্ধারিত করে দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে কোন হেরফের বা কমবেশি হবে না। তাহলে প্রশ্ন হয়ে যে, সবকিছু যদি আগেই নির্দিষ্ট হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে আমাদের কষ্ট করে আর আমল করার প্রয়োজন কি? তাছাড়া আমল করেই বা লাভ কী? ফায়সালা তো আগেই হয়ে গেছে। 


জবাবঃ

আপনি যে হাদীসটি শুনেছেন, তা সহীহ ও সঠিক। হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে উক্ত হাদীসটি বর্ণিত আছে। তবে উল্লেখিত হাদীসটির ব্যাপারে নিজে নিজে কোন সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করা উচিত নয়। কারণ তাকদীরের ব্যাপারে নিজের আকুল-বুদ্ধি দ্বারা গবেষণা করা বা তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়া অথবা বিস্তারিত অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করা শরী‘আতে নিষেধ। একথা ঠিক যে, আল্লাহ তা‘আলা তার পরিপূর্ণ জ্ঞান ও ইলমের দ্বারা লিখে রেখেছেন যে, নিজের এখতিয়ার অনুযায়ী আমল করে কোন বান্দা জান্নাতের বাসিন্দা হবে, আর কোন বান্দা হবে জাহান্নামের বাসিন্দা। তবে তিনি এরূপ কেন লিখে রেখেছেন, তা তিনিই ভালো জানেন। এর মধ্যে অনেক হিকমত নিহিত রয়েছে। আমাদের শুধু এতটুকুই জানতে হবে যে, এ ব্যাপারে আমাদের করণীয় কী? এর চেয়ে অগ্রসর হওয়া উচিত নয়। এ ব্যাপারে বান্দার যিম্মাদারী হলো, আল্লাহ তা‘আলার এই ফায়সালার ওপর ঈমান আনা এবং বাস্তবিক পক্ষে যে দু’টি কিতাব তৈরী আছে, তা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা। এতটুকু করলে আমাদের দায়িত্ব আদায় হয়ে গেল। এর ওপর ভিত্তি করে আমল না করা বা বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করা আমাদের দায়িত্ব বহির্ভূত বা অনধিকার চর্চার শামিল।


সারকথা, আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, উক্ত দুই কিতাবের ওপর ঈমান রাখা এবং নিজের ইখতিয়ার দ্বারা আল্লাহ তা‘আলার হুকুম-আহকাম ও বিধি নিষেধ বাস্তবায়ন করা। কারণ, উক্ত কিতাবদ্বয়ে কী লেখা আছে, তা আমাদের জানা নেই। তাছাড়া সেই লেখা দ্বারা আমাদের ইখতিয়ার ও শক্তি তো নষ্ট হয়ে যায় নি! সুতরাং, কিতাবে যা-ই লেখা থাকুক, আমাদের আমল করে যেতে হবে। এটাই বান্দার বন্দেগী ও তার দায়িত্ব। এরই মধ্যে তার সার্বিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে। উক্ত হাদীস শুনে আপনি যে প্রশ্ন করেছেন, স্বয়ং সাহাবায়ে কিরাম রাযি. ও একই প্রশ্ন করেছিলেন। তার জবাবে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে ভরসা করে বসে না থেকে আমল করতে বলেছিলেন। কারণ আমল বান্দার ইখতিয়ারের অন্তর্ভুক্ত বিষয়। 


উক্ত কিতাব দুটি সম্পর্কে একটি উদাহরণ পেশ করা হচ্ছে- আশা করা যায় যে, এর দ্বারা বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমন, একজন ন্যায়পরায়ণ মুসলিম বাদশাহের দরবারে বিভিন্ন লোকের যাতায়াত ও যোগাযোগ আছে। কেউ বাদশাহকে দ্বীনি ব্যাপারে সহযোগিতা করতে আসেন এবং তার দ্বীনদারীর কারণে বাদশাহ তাকে মুহাব্বত ও শ্রদ্ধা করেন। আবার অনেকে নিজের হীন স্বার্থ আদায়ের জন্যে বাদশাহের প্রতি বাহ্যত মুহাব্বত প্রদর্শন করবেন। এক সময় বাদশাহ ইচ্ছা প্রকাশ করলেন যে, প্রকৃত বাদশাহপ্রেমীদের পুরুষ্কৃত করবেন। কিন্তু সমস্যা হলো, নকল মুহাব্বতকারীরা দুর্নাম রটাবে যে, বাদশাহ মহোদয় আমাদের প্রতি ইনসাফ করলেন না। বাস্তবে আমরাও তাকে ভালোবাসি, কিন্তু তিনি আমাদেরকে পুরষ্কার না দিয়ে অন্যদেরকে দিলেন। এ সমস্যা থেকে বাঁচার জন্যে বাদশাহ একটা হিকমত অবলম্বন করলেন। বাদশাহ বললেন-১ম দফতরে যাদের নাম এসেছে, তাদেরকে নির্দিষ্ট তারিখে আমি পুরুষ্কৃত করব। আর ২য় দফতরে যাদের নাম এসেছে, তাদেরকে নির্দিষ্ট তারিখে আমি শাস্তি প্রদান করব এবং উভয় দফতর চূড়ান্ত করে শেষে মোটসংখ্যা লিখে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, এর মধ্যে পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই। বাদশাহের এই ঘোষণার পর প্রকৃত বাদশাহপ্রেমীগণ তাদের আচার-আচরণ ও দরবারে যাতায়াতের মধ্যে কোনরূপ পরিবর্তন করলেন না। তারা বললেন যে, আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে এই আল্লাহওয়ালা বাদশাহকে মুহাব্বত করছি এবং তার কাজে সহযোগিতা করছি। সুতরাং, আমরা নেক কাজ করেই যাব। চাই বাদশাহ আমাদেরকে পুরষ্কৃত করুন বা শাস্তি প্রদান করুন, এটা বাদশাহের নিজস্ব ব্যাপার। আর স্বার্থান্বেষী মহল বাদশাহের ঘোষণার পরে বাদশাহের দরবারে আসা-যাওয়া ও সহযোগিতা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিল। তারা বলতে লাগলো যে, দুটি দফতর যখন তৈরী হয়ে গেছে, তাহলে এখন দরবারে যাতায়াত বৃথা। কারণ, প্রথম দফতরে নাম থাকলে সর্বাবস্থায় পুরষ্কার পাওয়া যাবে। আর দ্বিতীয় দফতরে নাম থাকলে শাস্তি ভোগ করতেই হবে। সুতরাং দরবারে যাওয়া না যাওয়ার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। কাজেই দরবারে গিয়ে সময় নষ্ট না করে নিজের কাজ করাই ভালো। এর পরে নির্দিষ্ট তারিকে দেখা গেল যে, যারা দফতরের ওপর ভরসা করে যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছিল তারা তাদের অপরাধের শাস্তি পেয়েছে। আর যারা দফতরের ওপর নির্ভর না করে নিজের দায়িত্ব পালন করে গেছে, তারা সকলেই তাদের খালেস মুহাব্বতের কারণে পুরষ্কৃত হয়েছেন। এটা হলো উপরোক্ত বিষয়ের একটি উদাহরণ। এর ওপর ভিত্তি করে আমরা আল্লাহ তা‘আলার দুই কিতাবের স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারি। আল্লাহ তা‘আলা রুহের জগতে প্রথম যখন সকলকে জমা করেছিলেন, তখনই নিজের ইলম মুতাবিক এক দলকে জান্নাতে, আরেক দলকে জাহান্নামে পাঠাতে পারতেন, কিন্তু এমতাবস্থায় কাফির-মুশরিকদের আল্লাহর বিরুদ্ধে এই অভিযোগের সুযোগ থাকতো যে, আল্লাহ আমাদেরকে দুনিয়ায় পাঠিয়ে আমল করার সুযোগ দিলে আমরা অন্যদের থেকে বেশি আমল করতাম। কিন্তু আল্লাহ তো আমাদেরকে সুযোগই দিলেন না। কাজেই আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় ইলম দ্বারা ফায়সালা না করে সকলকে আমলের সুযোগ দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন এবং উভয় দফতরের কথা ঘোষণা করেছেন। এখন দুনিয়াতে যারা দফতরের ওপর ঈমান তো রাখবে, কিন্তু দফতরের ভরসায় আমল পরিত্যাগ করবে না, হাশরের ময়দানে দেখা যাবে যে, শুধু তাদেরই নাম জান্নাতী দফতরে লেখা আছে। আর যারা দফতরের ওপর নির্ভর করে আমল করেনি, দুনিয়ার ব্যাপারে তারা খুব বুদ্ধিমান হলেও আখিরাতের বিষয়ে বড়ই অলস । অথচ যুক্তি-তর্কে খুব পারদর্শী। হাশরের ময়দানে দেখা যাবে যে, এমন লোকগুলোর নাম জাহান্নামের খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সারকথা, আল্লাহর ও কিতাবদ্বয়ের ওপর নির্ভর করে আমল ছেড়ে দেয়া যাবে না, বরং আমল করতে থাকতে হবে। 

Comments

Popular posts from this blog

বেলা ফুরাবার আগে by আরিফ আজাদ বই pdf

বেলা ফুরাবার আগে by আরিফ আজাদ বই pdf.  এই বইটি ডাউনলোড করতে নিচের লিংকে Click করেন। ডাউনলোড লিংক   

সূরা ফালাকের তাফসীর

 সূরা ফালাকের তাফসীরঃ নামকরণ: সূরা ফালাক ও সূরা নাস উভয় সূরার নামকরণ করা হয়েছে সূরার প্রথম আয়াতে উল্লিখিত শব্দ থেকে। ফালাক (الفلق) শব্দের অর্থ : প্রভাতকাল। আর নাস (النَّاس) অর্থ : মানুষ। এ দুই সূরাকে একত্রে معوذتان বা আশ্রয় প্রার্থনা করার দুই সূরা বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জাদুগ্রস্থ হওয়ার পর এ সূরাদ্বয় দ্বারা ঝাড়ফুঁক করা হলে আল্লাহ তা‘আলার রহমতে তিনি সুস্থ হন, তাই এ নামেও এ সূরাদ্বয় পরিচিত। শানে নুযূল: মা আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, মদীনার ইয়াহূদী গোত্র বনু যুরাইকের মিত্র লাবীদ বিন আসাম নামক জনৈক মুনাফিক তার মেয়েকে দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাথার ছিন্নচুল ও চিরুনীর ছিন্ন দাঁত চুরি করে এনে তাতে জাদু করে এবং মন্ত্র পাঠ করে চুলে ১১টি গিরা দেয়। এর প্রভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কোন কাজ করলে ভুলে যেতেন ও ভাবতেন যে করেননি। অন্য বর্ণনা মতে ৪০ দিন বা ৬ মাস এভাবে থাকেন। এক রাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বপ্নে দেখেন যে, দু’জন লোক এসে একজন তাঁর মাথার কাছে অন্যজন পায়ের কাছে বসে। অতঃপর তারা বলে যে, বনু যুরাইকের খেজুর বাগানে যারওয়ান কূয়ার তলদেশে পাথরের নীচে চাপা দেয়া খেজুরের কাঁদির শুকনো খোস...

এহইয়াউস সিনান বই by ড. খোন্দকার আ.ন.ম. আব্দল্লাহ জাহাঙ্গীর

 এহইয়াউস সিনান বই by ড. খোন্দকার আ.ন.ম. আব্দল্লাহ জাহাঙ্গীর  এই বইটি  pdf ডাউনলোড লিংক